০৩:৩৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৬ জুলাই ২০২৫

বঙ্গোপসাগরে নতুন উত্তেজনার সূচনা: রাখাইন করিডোর নিয়ে চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্রের লড়াই

হক বার্তা ডেস্ক রিপোর্টঃ
  • আপডেট সময়ঃ ১২:৪৬:৫৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৬ জুলাই ২০২৫
  • / ২ বার পড়া হয়েছে।

রাখাইন করিডোর দ্রুত দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হচ্ছে। উত্তর রাখাইনে ত্রাণ পৌঁছে দেয়ার জন্য মানবিক করিডোর  হিসেবে গড়ে ওঠা এই প্রবেশপথটির নেপথ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কৌশল লুকিয়ে আছে।

রাখাইন রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ ক্রমশ আরাকান আর্মির (এএ) হাতে চলে আসার সাথে সাথে, তারা এখন মিয়ানমারের বেশিরভাগ ভূখণ্ডের উপর দৃঢ়ভাবে নিয়ন্ত্রণ জারি করেছে। এই করিডোরটি যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং আঞ্চলিক শক্তির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। ফলে, বাংলাদেশের এই প্রতিযোগিতার ফাঁদে আটকা পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। 

 

মানবিক সাহায্যের পেছনে কৌশলগত অভিপ্রায়

জনসমক্ষে করিডোরটি উত্তর রাখাইনের জন্য একটি মানবিক সাহায্য রুট হিসেবে তৈরি করা হয়েছে। সেখানে প্রায় দুই মিলিয়ন মানুষ দুর্ভিক্ষ, সংঘাত এবং বাস্তুচ্যুতির মুখোমুখি। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস কক্সবাজার সফরের সময় মানবিক সংকটের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য হ্রাসকে ‘অপরাধ’ বলেও উল্লেখ করেন। কিন্তু রাখাইন করিডোরের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তর কৌশল রয়েছে বলে অনেকে বিশ্বাস করেন। এই করিডোরটি শুধু সহায়তাই পৌঁছে দেবে না বরং বঙ্গোপসাগরের গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক সংযোগস্থলে পশ্চিমা প্রভাবকে আরও শক্তিশালী করবে। এই রুটটি খোলার জন্য জাতিসংঘ-মার্কিন-বাংলাদেশ প্রস্তাব ঢাকার প্রিটোরিয়ান গার্ড- বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান এই পরিকল্পনাকে ‘রক্তাক্ত করিডোর’ বলে সমালোচনা করেছেন, যা সার্বভৌম নিয়ন্ত্রণের সাথে আপস করার ঝুঁকি তৈরি করবে। এই করিডোরটি আক্ষরিক অর্থে  পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর জন্য চীনের পরিধিতে অবস্থিত মিয়ানমারে নরম বা কিছুটা দৃঢ় শক্তি প্রদর্শনের একটি সম্ভাব্য উপায় হতে পারে।

 

 

বাংলাদেশের দ্বিধা

নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বেসামরিক অন্তর্বর্তী সরকার যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের চাপের মুখে এই করিডোরে আগ্রহ দেখিয়েছে। একই সঙ্গে ইউনূস সামরিক বাহিনীর চাপের মধ্যেও রয়েছেন, যারা এই করিডোরকে একটি ফাঁদ হিসেবে দেখে। ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন করার জন্য ওয়াকারের মন্তব্য ইউনূসকে আরও দুর্বল করে তুলতে পারে, তিনি সংস্কার প্রক্রিয়া বিলম্বের মাধ্যমে নির্বাচনের বৈধতা খুঁজছেন। জেনারেল ওয়াকার এবং প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসের মধ্যে এই মতবিরোধ কোনও কাকতালীয় ঘটনা নয়। জেনারেল ওয়াকারের দৃষ্টিভঙ্গিকে ১৯৮০-এর দশকের পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে, যখন সোভিয়েত-বিরোধী মুজাহিদিনদের প্রতি মার্কিন সমর্থনের জন্য পাকিস্তানকে  দীর্ঘমেয়াদী মূল্য চোকাতে হয়েছিল। যার মধ্যে ছিল রাজনীতিতে ইসলামী উগ্রপন্থা, দেশের অভ্যন্তরে বিদেশি গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের স্থায়ী আধিপত্য এবং জিয়া উল-হক, পারভেজ মোশাররফ এবং পরবর্তী সরকারগুলোর অধীনে চার দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশে বিরাজমান অস্থিতিশীলতা। তাই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রস্তাবিত রাখাইন করিডোরকে মার্কিন-আফগান খেলার বইয়ের একটি বিপজ্জনক অধ্যায় হিসেবে দেখে। এর জেরে বাংলাদেশ  মিয়ানমারে একটি প্রক্সি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার এবং মার্কিন প্রভাব বলয়ের আরও গভীরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা করছে।

চীনের দৃষ্টিকোণ

বেইজিংয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে রাখাইন করিডোর চীনের বিরক্তির কারণ। কিয়াকফিউ বন্দর, যা সম্ভবত ২০২৫ সালের শেষের দিকে চালু হওয়ার কথা, দক্ষিণ রাখাইনে অবস্থিত এবং এটি বেইজিংয়ের স্থল-সমুদ্র রুটের কেন্দ্রস্থল যা মালাক্কা প্রণালীকে বাইপাস করে। রাখাইনে পশ্চিমা প্রভাব বিস্তারের জন্য এই মার্কিন-জাতিসংঘ করিডোর চীনের কৌশলকে ম্লান করে দিতে পারে। বেইজিং মিয়ানমারের জান্তার সাথেও দৃঢ় সম্পর্ক বজায় রেখেছে এবং জাতিগত গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে নিরাপত্তা সহযোগিতায় ব্যাপক বিনিয়োগ করছে, যার মধ্যে রয়েছে এএ-কে নীরব সমর্থন। সুতরাং, যে কোনও করিডোর মারফত  আরাকান আর্মির ক্ষমতায়নকে চীন ভালো চোখে দেখবে না।

 

 

ভারতের নীরব ভূমিকা

ভারতের অবস্থান বেশ জটিল। কাগজে-কলমে নয়াদিল্লির ওয়াশিংটনের সাথে সমন্বয় করা উচিত, তবে বাস্তবে রাখাইনে দিল্লির স্বার্থ বেইজিংয়ের আশঙ্কার সাথে মিলে যায়। ভারত কালাদান প্রকল্পে যথেষ্ট বিনিয়োগ করেছে; তাই, উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে বাণিজ্য ও যোগাযোগ উন্নত করার জন্য উত্তর রাখাইনে স্থিতিশীলতা প্রয়োজন। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তাদের ঝুঁকিপূর্ণ উত্তর-পূর্বাঞ্চলে দখলদারিত্ব ভারত মেনে নিতে পারে না।

অতএব, ভারতকে অবশ্যই নীরবে জেনারেল ওয়াকারের অবস্থানকে গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। এর মাধ্যমে, এটি বাংলাদেশের কৌশলকে সীমিত করবে, মার্কিন প্রভাব বিস্তারকে বাধা দেবে এবং ভারতকে এএ বা চিন রাজ্যের বিদ্রোহীদের মতো জান্তা-বিরোধী সত্তাগুলোর সাথে আরও গভীরভাবে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ করে দেবে। ভারতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তারা এএ প্রতিনিধিদের সাথে দেখা করার পর থেকে অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগের প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে মিজোরামে, যেখানে ভারত মিয়ানমার গৃহযুদ্ধে জড়িত কোনও একক সত্তার সাথে প্রকাশ্যে জোটবদ্ধ না হয়ে অ-প্রাণঘাতী সহায়তা এবং কূটনৈতিক চ্যানেল সরবরাহ করেছে।

আরাকান সেনাবাহিনীর উত্থান এবং ঝুঁকি

আরাকান আর্মি এখন রাখাইন রাজ্যের প্রায় ৯০ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে, যার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সীমান্তবর্তী শহরগুলোও রয়েছে। কিন্তু এই আধিপত্য ঝুঁকির উদ্রেক করে। এএ-নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের মধ্য দিয়ে সাহায্য পৌঁছে দেয়ার একটি করিডোর বিদ্রোহী কর্তৃত্বকে বৈধতা দিতে পারে, যা মিয়ানমারের আঞ্চলিক অখণ্ডতাকে ক্ষুণ্ন করবে এবং এই অঞ্চলটিকে  প্রতিযোগিতার কেন্দ্রস্থলে পরিণত করবে। বাংলাদেশের জন্য এর অর্থ হবে সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে জড়িয়ে পড়া এবং মিয়ানমার সরকার ও চীন উভয়ের কাছ থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হওয়া।

কৌশলগত খেলা

রাখাইন করিডোর ইস্যুটি এত গুরুত্বপূর্ণ যে এটি ভবিষ্যতের প্রক্সি সংঘাতের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলতে পারে। মানবিক সহায়তা ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের সূত্রপাত ঘটায়। তাই বাংলাদেশের সেনাবাহিনী ফাঁদের গন্ধ পাচ্ছে এবং চীন হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত পাচ্ছে। তবে, ভারত তার নিজস্ব শর্তে নিজের অবস্থানকে তুলে ধরার একটি সুযোগ দেখছে এবং এএ  এটিকে মূলধারার ভূ-রাজনীতিতে প্রবেশের সুযোগ হিসেবে দেখছে। বন্ধ দরজার আড়ালে থেকে যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্য প্রতিক্রিয়া আটকাতে তার প্রস্তাবটি ধীর গতিতে এগিয়ে নিয়ে চলেছে, কিন্তু ২০২২ সালের বার্মা আইন এবং ওয়াশিংটনের ক্রমবর্ধমান সমর্থন কৌশলগত নকশাটি প্রকাশ্যে এনে দিয়েছে।

আগামী কয়েক মাসে যা ঘটবে তা বছরের পর বছর ধরে বঙ্গোপসাগরের রূপরেখা নির্ধারণ করবে। যদি বাংলাদেশ এই করিডোর বেছে নেয়, তাহলে সামরিক বাহিনী তাদের প্রতিক্রিয়া দেখাবে, অথবা পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। বিভক্ত শাসনব্যবস্থা এবং বহিরাগত হস্তক্ষেপের ঝুঁকি থাকবে। যদি সেনাবাহিনী নির্বাচন অনুষ্ঠানের উপর জোর দেয় এবং করিডোরটি প্রত্যাখ্যান করে, তাহলে আমরা ভারত ও চীনের সাথে একটি নীরব জোট দেখতে পাব, যার ফলে উত্তর রাখাইনকে সুরক্ষিত করতে বা করিডোর বন্ধ করার ক্ষেত্রে ভারতের আরও সক্রিয় ভূমিকার সম্ভাবনা রয়েছে।

দিল্লির জন্য, জেনারেল ওয়াকারকে সমর্থন করা বাস্তবসম্মত কারণ এটি তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে সুরক্ষিত করবে, বাংলাদেশকে নিয়ন্ত্রণে রাখবে এবং মিয়ানমারের জাতিগত শক্তির সাথে ভবিষ্যতের যেকোনো আলোচনায় ভারত মূল ভূমিকা পালন করতে পারবে। বেইজিংয়ের জন্য, করিডোরের ব্যর্থতা তার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রভাব ক্ষেত্রকে অক্ষুণ্ন রাখবে, কিয়াকফিউকে রক্ষা করবে এবং এই অঞ্চলে আমেরিকান অনুপ্রবেশ রোধ করবে।

উপসংহার

রাখাইন করিডোর কেবল সাহায্যের পথই নয়, বরং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বৃহৎ শক্তির উদীয়মান প্রতিযোগিতা দেখার একটি প্রিজম হয়ে উঠেছে। এই প্রতিযোগিতা কোনো যুদ্ধজাহাজ নিয়ে নয়, বরং রসদ এবং অবকাঠামো নিয়ে সংঘটিত হয়েছিল। বাংলাদেশ এই মহান খেলার একটি ভঙ্গুর কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত। তার  নীতিগত পছন্দ নির্ধারণ করবে যে বাংলাদেশ সার্বভৌমত্ব বজায় রাখবে নাকি বহিরাগত উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্য একটি মঞ্চস্থল হয়ে উঠবে। তাই এই মানবিক করিডোর নিয়ে অনেক ঝুঁকি  রয়েছে। ভারত মহাসাগরে কে প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রণ করবে? রাখাইনের বন্দরের কাছে কার পতাকা উড়বে? করিডোরে কার আদেশ চলবে তা বলবে ভবিষ্যৎ। তাই ঢাকা থেকে দিল্লি, বেইজিং থেকে ওয়াশিংটন সবাই ঝুঁকির মুখে। বলা যায় প্রতিযোগিতা সবেমাত্র শুরু হয়েছে।

(লেখক ভারতীয় সেনাবাহিনীর দক্ষিণপশ্চিম, পূর্বাঞ্চল ও কেন্দ্রীয় কমান্ডের একজন সাবেক কমান্ডার। দ্য ইউরেশিয়ান টাইমসে প্রকাশিত তার লেখার অনুবাদ)

 

নিউজটি শেয়ার করুন

বিস্তারিত লিখুনঃ

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষণ করুন

বঙ্গোপসাগরে নতুন উত্তেজনার সূচনা: রাখাইন করিডোর নিয়ে চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্রের লড়াই

আপডেট সময়ঃ ১২:৪৬:৫৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৬ জুলাই ২০২৫

রাখাইন করিডোর দ্রুত দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হচ্ছে। উত্তর রাখাইনে ত্রাণ পৌঁছে দেয়ার জন্য মানবিক করিডোর  হিসেবে গড়ে ওঠা এই প্রবেশপথটির নেপথ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কৌশল লুকিয়ে আছে।

রাখাইন রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ ক্রমশ আরাকান আর্মির (এএ) হাতে চলে আসার সাথে সাথে, তারা এখন মিয়ানমারের বেশিরভাগ ভূখণ্ডের উপর দৃঢ়ভাবে নিয়ন্ত্রণ জারি করেছে। এই করিডোরটি যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং আঞ্চলিক শক্তির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। ফলে, বাংলাদেশের এই প্রতিযোগিতার ফাঁদে আটকা পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। 

 

মানবিক সাহায্যের পেছনে কৌশলগত অভিপ্রায়

জনসমক্ষে করিডোরটি উত্তর রাখাইনের জন্য একটি মানবিক সাহায্য রুট হিসেবে তৈরি করা হয়েছে। সেখানে প্রায় দুই মিলিয়ন মানুষ দুর্ভিক্ষ, সংঘাত এবং বাস্তুচ্যুতির মুখোমুখি। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস কক্সবাজার সফরের সময় মানবিক সংকটের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য হ্রাসকে ‘অপরাধ’ বলেও উল্লেখ করেন। কিন্তু রাখাইন করিডোরের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তর কৌশল রয়েছে বলে অনেকে বিশ্বাস করেন। এই করিডোরটি শুধু সহায়তাই পৌঁছে দেবে না বরং বঙ্গোপসাগরের গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক সংযোগস্থলে পশ্চিমা প্রভাবকে আরও শক্তিশালী করবে। এই রুটটি খোলার জন্য জাতিসংঘ-মার্কিন-বাংলাদেশ প্রস্তাব ঢাকার প্রিটোরিয়ান গার্ড- বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান এই পরিকল্পনাকে ‘রক্তাক্ত করিডোর’ বলে সমালোচনা করেছেন, যা সার্বভৌম নিয়ন্ত্রণের সাথে আপস করার ঝুঁকি তৈরি করবে। এই করিডোরটি আক্ষরিক অর্থে  পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর জন্য চীনের পরিধিতে অবস্থিত মিয়ানমারে নরম বা কিছুটা দৃঢ় শক্তি প্রদর্শনের একটি সম্ভাব্য উপায় হতে পারে।

 

 

বাংলাদেশের দ্বিধা

নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বেসামরিক অন্তর্বর্তী সরকার যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের চাপের মুখে এই করিডোরে আগ্রহ দেখিয়েছে। একই সঙ্গে ইউনূস সামরিক বাহিনীর চাপের মধ্যেও রয়েছেন, যারা এই করিডোরকে একটি ফাঁদ হিসেবে দেখে। ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন করার জন্য ওয়াকারের মন্তব্য ইউনূসকে আরও দুর্বল করে তুলতে পারে, তিনি সংস্কার প্রক্রিয়া বিলম্বের মাধ্যমে নির্বাচনের বৈধতা খুঁজছেন। জেনারেল ওয়াকার এবং প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসের মধ্যে এই মতবিরোধ কোনও কাকতালীয় ঘটনা নয়। জেনারেল ওয়াকারের দৃষ্টিভঙ্গিকে ১৯৮০-এর দশকের পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে, যখন সোভিয়েত-বিরোধী মুজাহিদিনদের প্রতি মার্কিন সমর্থনের জন্য পাকিস্তানকে  দীর্ঘমেয়াদী মূল্য চোকাতে হয়েছিল। যার মধ্যে ছিল রাজনীতিতে ইসলামী উগ্রপন্থা, দেশের অভ্যন্তরে বিদেশি গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের স্থায়ী আধিপত্য এবং জিয়া উল-হক, পারভেজ মোশাররফ এবং পরবর্তী সরকারগুলোর অধীনে চার দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশে বিরাজমান অস্থিতিশীলতা। তাই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রস্তাবিত রাখাইন করিডোরকে মার্কিন-আফগান খেলার বইয়ের একটি বিপজ্জনক অধ্যায় হিসেবে দেখে। এর জেরে বাংলাদেশ  মিয়ানমারে একটি প্রক্সি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার এবং মার্কিন প্রভাব বলয়ের আরও গভীরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা করছে।

চীনের দৃষ্টিকোণ

বেইজিংয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে রাখাইন করিডোর চীনের বিরক্তির কারণ। কিয়াকফিউ বন্দর, যা সম্ভবত ২০২৫ সালের শেষের দিকে চালু হওয়ার কথা, দক্ষিণ রাখাইনে অবস্থিত এবং এটি বেইজিংয়ের স্থল-সমুদ্র রুটের কেন্দ্রস্থল যা মালাক্কা প্রণালীকে বাইপাস করে। রাখাইনে পশ্চিমা প্রভাব বিস্তারের জন্য এই মার্কিন-জাতিসংঘ করিডোর চীনের কৌশলকে ম্লান করে দিতে পারে। বেইজিং মিয়ানমারের জান্তার সাথেও দৃঢ় সম্পর্ক বজায় রেখেছে এবং জাতিগত গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে নিরাপত্তা সহযোগিতায় ব্যাপক বিনিয়োগ করছে, যার মধ্যে রয়েছে এএ-কে নীরব সমর্থন। সুতরাং, যে কোনও করিডোর মারফত  আরাকান আর্মির ক্ষমতায়নকে চীন ভালো চোখে দেখবে না।

 

 

ভারতের নীরব ভূমিকা

ভারতের অবস্থান বেশ জটিল। কাগজে-কলমে নয়াদিল্লির ওয়াশিংটনের সাথে সমন্বয় করা উচিত, তবে বাস্তবে রাখাইনে দিল্লির স্বার্থ বেইজিংয়ের আশঙ্কার সাথে মিলে যায়। ভারত কালাদান প্রকল্পে যথেষ্ট বিনিয়োগ করেছে; তাই, উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে বাণিজ্য ও যোগাযোগ উন্নত করার জন্য উত্তর রাখাইনে স্থিতিশীলতা প্রয়োজন। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তাদের ঝুঁকিপূর্ণ উত্তর-পূর্বাঞ্চলে দখলদারিত্ব ভারত মেনে নিতে পারে না।

অতএব, ভারতকে অবশ্যই নীরবে জেনারেল ওয়াকারের অবস্থানকে গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। এর মাধ্যমে, এটি বাংলাদেশের কৌশলকে সীমিত করবে, মার্কিন প্রভাব বিস্তারকে বাধা দেবে এবং ভারতকে এএ বা চিন রাজ্যের বিদ্রোহীদের মতো জান্তা-বিরোধী সত্তাগুলোর সাথে আরও গভীরভাবে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ করে দেবে। ভারতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তারা এএ প্রতিনিধিদের সাথে দেখা করার পর থেকে অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগের প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে মিজোরামে, যেখানে ভারত মিয়ানমার গৃহযুদ্ধে জড়িত কোনও একক সত্তার সাথে প্রকাশ্যে জোটবদ্ধ না হয়ে অ-প্রাণঘাতী সহায়তা এবং কূটনৈতিক চ্যানেল সরবরাহ করেছে।

আরাকান সেনাবাহিনীর উত্থান এবং ঝুঁকি

আরাকান আর্মি এখন রাখাইন রাজ্যের প্রায় ৯০ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে, যার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সীমান্তবর্তী শহরগুলোও রয়েছে। কিন্তু এই আধিপত্য ঝুঁকির উদ্রেক করে। এএ-নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের মধ্য দিয়ে সাহায্য পৌঁছে দেয়ার একটি করিডোর বিদ্রোহী কর্তৃত্বকে বৈধতা দিতে পারে, যা মিয়ানমারের আঞ্চলিক অখণ্ডতাকে ক্ষুণ্ন করবে এবং এই অঞ্চলটিকে  প্রতিযোগিতার কেন্দ্রস্থলে পরিণত করবে। বাংলাদেশের জন্য এর অর্থ হবে সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে জড়িয়ে পড়া এবং মিয়ানমার সরকার ও চীন উভয়ের কাছ থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হওয়া।

কৌশলগত খেলা

রাখাইন করিডোর ইস্যুটি এত গুরুত্বপূর্ণ যে এটি ভবিষ্যতের প্রক্সি সংঘাতের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলতে পারে। মানবিক সহায়তা ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের সূত্রপাত ঘটায়। তাই বাংলাদেশের সেনাবাহিনী ফাঁদের গন্ধ পাচ্ছে এবং চীন হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত পাচ্ছে। তবে, ভারত তার নিজস্ব শর্তে নিজের অবস্থানকে তুলে ধরার একটি সুযোগ দেখছে এবং এএ  এটিকে মূলধারার ভূ-রাজনীতিতে প্রবেশের সুযোগ হিসেবে দেখছে। বন্ধ দরজার আড়ালে থেকে যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্য প্রতিক্রিয়া আটকাতে তার প্রস্তাবটি ধীর গতিতে এগিয়ে নিয়ে চলেছে, কিন্তু ২০২২ সালের বার্মা আইন এবং ওয়াশিংটনের ক্রমবর্ধমান সমর্থন কৌশলগত নকশাটি প্রকাশ্যে এনে দিয়েছে।

আগামী কয়েক মাসে যা ঘটবে তা বছরের পর বছর ধরে বঙ্গোপসাগরের রূপরেখা নির্ধারণ করবে। যদি বাংলাদেশ এই করিডোর বেছে নেয়, তাহলে সামরিক বাহিনী তাদের প্রতিক্রিয়া দেখাবে, অথবা পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। বিভক্ত শাসনব্যবস্থা এবং বহিরাগত হস্তক্ষেপের ঝুঁকি থাকবে। যদি সেনাবাহিনী নির্বাচন অনুষ্ঠানের উপর জোর দেয় এবং করিডোরটি প্রত্যাখ্যান করে, তাহলে আমরা ভারত ও চীনের সাথে একটি নীরব জোট দেখতে পাব, যার ফলে উত্তর রাখাইনকে সুরক্ষিত করতে বা করিডোর বন্ধ করার ক্ষেত্রে ভারতের আরও সক্রিয় ভূমিকার সম্ভাবনা রয়েছে।

দিল্লির জন্য, জেনারেল ওয়াকারকে সমর্থন করা বাস্তবসম্মত কারণ এটি তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে সুরক্ষিত করবে, বাংলাদেশকে নিয়ন্ত্রণে রাখবে এবং মিয়ানমারের জাতিগত শক্তির সাথে ভবিষ্যতের যেকোনো আলোচনায় ভারত মূল ভূমিকা পালন করতে পারবে। বেইজিংয়ের জন্য, করিডোরের ব্যর্থতা তার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রভাব ক্ষেত্রকে অক্ষুণ্ন রাখবে, কিয়াকফিউকে রক্ষা করবে এবং এই অঞ্চলে আমেরিকান অনুপ্রবেশ রোধ করবে।

উপসংহার

রাখাইন করিডোর কেবল সাহায্যের পথই নয়, বরং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বৃহৎ শক্তির উদীয়মান প্রতিযোগিতা দেখার একটি প্রিজম হয়ে উঠেছে। এই প্রতিযোগিতা কোনো যুদ্ধজাহাজ নিয়ে নয়, বরং রসদ এবং অবকাঠামো নিয়ে সংঘটিত হয়েছিল। বাংলাদেশ এই মহান খেলার একটি ভঙ্গুর কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত। তার  নীতিগত পছন্দ নির্ধারণ করবে যে বাংলাদেশ সার্বভৌমত্ব বজায় রাখবে নাকি বহিরাগত উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্য একটি মঞ্চস্থল হয়ে উঠবে। তাই এই মানবিক করিডোর নিয়ে অনেক ঝুঁকি  রয়েছে। ভারত মহাসাগরে কে প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রণ করবে? রাখাইনের বন্দরের কাছে কার পতাকা উড়বে? করিডোরে কার আদেশ চলবে তা বলবে ভবিষ্যৎ। তাই ঢাকা থেকে দিল্লি, বেইজিং থেকে ওয়াশিংটন সবাই ঝুঁকির মুখে। বলা যায় প্রতিযোগিতা সবেমাত্র শুরু হয়েছে।

(লেখক ভারতীয় সেনাবাহিনীর দক্ষিণপশ্চিম, পূর্বাঞ্চল ও কেন্দ্রীয় কমান্ডের একজন সাবেক কমান্ডার। দ্য ইউরেশিয়ান টাইমসে প্রকাশিত তার লেখার অনুবাদ)