সিলেটে রাতভর আড্ডাবাজি, বাড়ছে অপরাধ

- আপডেট সময়ঃ ১২:১৯:৫৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ২১ জুন ২০২৫
- / ৫ বার পড়া হয়েছে।
সিলেট নগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে রাতভর আড্ডাবাজিতে লিপ্ত হয়ে পড়ছে এক শ্রেণির তরুণরা। নগরীর বিভিন্ন স্থানগুলোতে বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নাম ভাঙিয়ে বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে আড্ডাবাজি। নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে কোন্দলীয়ভাবে বিভিন্ন গ্রুপ ভাগ করে রাতভর নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে, মার্কেটের সামনে, সড়কের পাশে ও আবাসিক এলাকার প্রবেশদ্বারে দেদারসে চলে এই আড্ডা।
স্থানীয়দের অভিযোগ, এসব তরুণ দল বেঁধে বিভিন্ন চায়ের দোকান, ফাস্টফুড কর্নার বা খোলা জায়গায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে উচ্চ শব্দে কথা বলা, অশালীন শব্দ ব্যবহার, মোটরসাইকেলের হর্ন বাজানো, কখনো কখনো ধূমপান ও মাদক সেবনের মতো কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ করে রাতভর এসকল আড্ডা থেকেই নিয়ন্ত্রিত হয় ভারতীয় চোরাইপণ্যের ভাগ-বাটোয়ারা, চাঁদাবাজি ও দখলবাজিসহ নানা ধরণের অপকর্ম। আর এতে শুধু সাধারণ মানুষ নয়, আশপাশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে।
সূত্র জানায়, বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নাম ভাঙিয়ে সিলেট নগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে, বিশেষ করে বন্দরবাজার, কোর্ট পয়েন্ট, জিন্দাবাজার, চৌহাট্টা, শিবগঞ্জ, টিলাগড়, বালুচর, সাপ্লাই, আম্বরখানা, সুবিদবাজার, মদিনামার্কেট, বাগবাড়ী পয়েন্ট, সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল, শেখঘাট, জিতুমিয়ার পয়েন্ট, তালতলা, উপশহর ও তেররতনসহ বিভিন্ন এলাকায় রাতভর আড্ডাবাজিতে দেখা যায়।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এসব আড্ডার অন্তরালে নানা অপরাধমূলক কর্মকান্ড পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করা হতো। ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের পট পরিবর্তনের পর নগরীর রাস্তার মোড়ে মোড়ে আস্তানা গড়ে তোলা ক্যাডারভিত্তিক নেতারা পলাতক রয়েছেন। তবে থেকে গেছে তাদের কিশোরগ্যাংয়ের সদস্যরা। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কিশোরগ্যাংয়ের এসব সদস্য ও সুযোগসন্ধানীরা পেয়ে গেছে বিএনপির অঙ্গ সংগঠনের বিভিন্ন নেতার সান্নিধ্য। গ্রুপভিত্তিক বিভিন্ন নেতার ছত্রছায়ায় এইসকল সুযোগসন্ধানীরা সিলেট নগরীর বিভিন্ন মোড় ও রাস্তা দখল করে বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডায় মেতে থাকে। আর এসব আড্ডাস্থল থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয় বিভিন্ন ধরণের অপরাধ। এ নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
সিলেটের শিক্ষাবিদ ও বিশ্লেষকরা বলছেন,‘অনেকেই সংগঠনের নাম ব্যবহার করে নিজেদের একটা ‘আইডেনটিটি’ তৈরি করতে চায়। অথচ প্রকৃত অর্থে যদি তারা সংগঠনচর্চায় যুক্ত হতো, তাহলে সমাজের উপকারেই আসতো। কিন্তু এখানে দেখা যাচ্ছে সংগঠনের নামে অপসংস্কৃতির চর্চা চলছে। তরুণদের এই প্রবণতার পেছনে রয়েছে নিজেকে জাহির করার প্রবণতা, কর্মসংস্থানের অভাব, সময়ের সদ্ব্যবহারে অনীহা এবং আধুনিক প্রযুক্তির নেতিবাচক প্রভাব। আবার অনেক সময় অভিভাবক পর্যায়ে নজরদারির ঘাটতির জন্য এই পরিস্থিতিকে ঘনীভূত করে।’
নগরীর শেখঘাট এলাকার তোফায়েল নামের এক দোকান মালিক বলেন, ‘রাতে দোকান বন্ধ করলেও সামনে অনেক তরুণ বসে থাকে। কেউ ‘সাংগঠনিক মিটিং’ বলে, কেউ বলে ‘ডিসকাশন চলছে’। অথচ! মূলত এগুলো তাদের আড্ডাবাজির অংশ। আমরা কিছু বলতে পারি না তাদের, কিছু বলতে গেলে ঝামেলার সৃষ্টি হয়। আর কখনো কখনো ছোট-খাটো বিষয় থেকে বড় বড় ঝামেলার তৈরি হয়।’
ছুমাইয়া (ছদ্মনাম/নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) নামের এক কলেজছাত্রী বলেন, ‘প্রতিদিন ক্লাস শেষ করে বাসায় ফেরার পথে খুব আতঙ্ক নিয়ে চলাফেরা করতে হয়। নগরীর বিভিন্ন মোড়ে, স্কুল-কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে বখাটে ছেলেরা আড্ডা দেয়। ধুমপান করে অনেক সময় ইভটিজিংয়ের মতো ঘটনা ঘটছে। আমরা ভয়ে কাউকে কিছু বলতে সাহস পাই না। এসব বখাটে গ্যাংয়ের কারণে অনেক সময় অস্বস্তিতে পড়তে হয়। সিলেট থেকে বখাটেদের আড্ডাবাজি রুখতে আমরা দ্রুত প্রসাশনের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।’
এদিকে সিলেটের সচেতন মহলের দাবি- প্রশাসনকে এ বিষয়ে আরও কঠোর হতে হবে। রাত ১০টার পর প্রকাশ্যে আড্ডাবাজি নিয়ন্ত্রণ, সন্দেহজনক চলাফেরা নজরদারি, এবং তরুণদের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক ক্যাম্পেইন পরিচালনা করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। সর্বোপরি, সমাজের প্রতিটি স্তরে—পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসন—সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ না করলে এ ধরনের আড্ডাবাজির সংস্কৃতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াবে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
”এই আড্ডাবাজি রুখতে হলে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে নয়তো এই সমস্যার পুরোপুরি সমাধান সম্ভব হবে না।’’
সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী বলেন, ‘সিলেট জেলা ও মহানগর বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা কোথাও আড্ডা দিচ্ছেন কিংবা অপকর্মে জড়াচ্ছেন অথবা জনসাধারণের কোনো ক্ষতির কারণ হয়েছেন এরকম কোনো তথ্য পেলে সিলেট বিএনপি ওইসকল নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। পাশাপাশি দলের ও অঙ্গ সংগঠনের নামে কেউ যদি তার রাজনৈতিক বলয় তৈরি করতে চায় আমরা তাদের বিরুদ্ধেও সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিবো। সড়কের মোড়ে, রাস্তাঘাটে কিংবা মার্কেটের সামনে আড্ডা দিয়ে দলীয় রাজনীতি হয় না। এইসকল অহেতুক আড্ডা দিলে মানুষের মনে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়। ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে রাতভর এই আড্ডাবাজি থেকে অনেক অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটেছে। তাই সিলেটে বিএনপি নেতাকর্মীদের এ ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে।’
সিলেট মেট্টোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম জানান, ‘সিলেট নগরীর বিভিন্নমোড়ে রাতভর যে আড্ডাবাজি সংঘটিত হয়। আমরা এই বিষয়টি পর্যবেক্ষণে রেখেছি। অনেক সময় আড্ডার আড়ালে অপরাধ সংঘটিত হয়, তাই কোনো অভিযোগ পেলে আমরা দ্রুত ব্যবস্থা নিচ্ছি। তাছাড়া নগরীতে টহল পুলিশের তদারকির পাশাপাশি গোয়েন্দা পুলিশের নজরদারিও রয়েছে। তবে বিশেষ করে এই আড্ডাবাজি রুখতে হলে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে নয়তো এই সমস্যার পুরোপুরি সমাধান সম্ভব হবে না।’
সুত্র:সিলেটভিউ24